ডায়াবেটিক রোগীদের গ্রীষ্মের মিষ্টি ফল খাওয়ার নিয়ম


 গ্রীষ্মকাল মানেই নানা রসালো ফলের সমারোহ। আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল, তরমুজ—এই সব মিষ্টি ফল ডায়াবেটিক রোগীদের মনে সংশয় তৈরি করে। অনেকেই মনে করেন, ডায়াবেটিস থাকলে মিষ্টি ফল খাওয়া একদমই নিষেধ। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। পরিমিত পরিমাণে এবং নিয়ম মেনে চললে ডায়াবেটিক রোগীরাও গ্রীষ্মের এই মিষ্টি ফলগুলো উপভোগ করতে পারেন। মূল বিষয় হলো, কোন ফল কতটা খাবেন এবং কীভাবে খাবেন, তা জানা।

ডায়াবেটিক রোগীদের ফল খাওয়ার মূলনীতি:

ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য ফল খাওয়ার ক্ষেত্রে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মাথায় রাখা উচিত:

১. গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (GI): এটি নির্দেশ করে কোনো খাবার খাওয়ার পর রক্তে শর্করার মাত্রা কতটা দ্রুত বাড়ায়। ৫৫ বা তার কম জিআই যুক্ত খাবারকে 'কম জিআই' ধরা হয়, যা ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য তুলনামূলকভাবে নিরাপদ। ৫৬-৬৯ মধ্যম এবং ৭০-এর বেশি জিআই উচ্চ বলে বিবেচিত হয়।

২. গ্লাইসেমিক লোড (GL): এটি আরও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি খাবারের পরিমাণ এবং গ্লাইসেমিক ইনডেক্স উভয়কেই বিবেচনা করে। জিএল ১০-এর নিচে থাকলে তাকে 'কম জিএল' ধরা হয়, যা ডায়াবেটিক রোগীর জন্য নিরাপদ।

কোনো ফলই ডায়াবেটিক রোগীর জন্য পুরোপুরি নিষিদ্ধ নয়, বরং পরিমাণের ওপরই মূল নিয়ন্ত্রণ।

গ্রীষ্মের জনপ্রিয় ফলের কিছু নিয়ম:

  • আম: ফলের রাজা আমে চিনির পরিমাণ বেশি হলেও, পরিমিত পরিমাণে খাওয়া যেতে পারে। একটি মাঝারি আকারের আম দিনে অর্ধেক বা ছোট আকারের হলে একটি খাওয়া যাবে। আমের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ৫৬-৫৯ (মধ্যম)। তাই আম খেলে ওই দিনের অন্য মিষ্টি জাতীয় ফল বা শর্করা জাতীয় খাবার কমিয়ে দিতে হবে। একবারে বেশি আম খাওয়া যাবে না।
  • লিচু: লিচুতে দুটো অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট যৌগ আছে, যা রোগ প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে। লিচুর গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ৫০ এবং গ্লাইসেমিক লোড ৭.৬, যা ডায়াবেটিক রোগীর জন্য নিরাপদ। যদি সুগার নিয়ন্ত্রণে থাকে, তাহলে একজন ডায়াবেটিক রোগী প্রতিদিন ৪০ গ্রাম লিচু অর্থাৎ বড় আকারের ছয়টি পর্যন্ত লিচু খেতে পারেন। তবে, ওই দিন অন্য মিষ্টি ফল এড়িয়ে চলুন।
  • তরমুজ: তরমুজে প্রায় ৯২ শতাংশ পানি থাকে, যা গ্রীষ্মে শরীরকে আর্দ্র রাখতে দারুণ কাজ করে। তবে, তরমুজের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স তুলনামূলকভাবে উচ্চ (৭৬)। কিন্তু এর গ্লাইসেমিক লোড মাত্র ২, যা খুবই কম। তাই, যাদের সুগার নিয়ন্ত্রণে আছে, তারা প্রতিদিন ১৫০-২০০ গ্রাম পর্যন্ত তরমুজ খেতে পারেন। তরমুজের সাথে প্রোটিন বা ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার (যেমন দই বা বাদাম) খেলে গ্লাইসেমিক লোড আরও কমে আসবে।
  • কাঁঠাল: বাংলাদেশের জাতীয় ফল কাঁঠালও গ্রীষ্মে জনপ্রিয়। পাকা কাঁঠালে শর্করার পরিমাণ বেশি। ডায়াবেটিক রোগীরা দিনে ৩-৪টি কাঁঠালের কোষ খেতে পারেন। কাঁঠাল খেলে ওই দিন অন্য কোনো মিষ্টি ফল বা বেশি শর্করাযুক্ত খাবার না খাওয়াই ভালো।
  • জাম: জাম ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য খুবই উপকারী। এতে থাকা যৌগ ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়াতে সাহায্য করে এবং রক্তে চিনি ও চর্বি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। জামের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম। ডায়াবেটিস রোগীরা নিশ্চিন্তে পরিমিত পরিমাণে জাম খেতে পারেন।
  • পেঁপে (পাকা): পাকা পেঁপেতে চিনির পরিমাণ কম থাকে এবং এতে ফাইবার ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টও থাকে। পাকা পেঁপের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম, তাই এটি ডায়াবেটিক রোগীরা পরিমিত পরিমাণে খেতে পারেন।
  • শসা: যদিও শসা ফল হিসেবে ততটা মিষ্টি নয়, এটি গ্রীষ্মকালে শরীরকে সতেজ রাখতে খুব ভালো কাজ করে। শসাতে প্রচুর পানি থাকে এবং এর গ্লাইসেমিক ইনডেক্স খুবই কম। তাই এটি ডায়াবেটিক রোগীরা ইচ্ছেমতো খেতে পারেন।

ফল খাওয়ার সাধারণ নিয়মাবলী:

  • পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ: যেকোনো ফলই পরিমিত পরিমাণে গ্রহণ করুন। ডাক্তারের বা পুষ্টিবিদের পরামর্শ অনুযায়ী আপনার জন্য সঠিক পরিমাণ জেনে নিন।
  • খাবার সময়: শুধু ফল না খেয়ে, অন্য কোনো খাবার (যেমন প্রোটিন বা ফাইবারযুক্ত স্ন্যাকস) এর সাথে ফল খেলে রক্তে শর্করার মাত্রা দ্রুত বাড়ে না। যেমন, বাদাম বা দইয়ের সঙ্গে ফল খাওয়া যেতে পারে।
  • একবারে বেশি নয়: একবারে অনেক ফল না খেয়ে, সারাদিন ছোট ছোট অংশে ভাগ করে খান।
  • সকালের নাস্তা বা বিকেলের স্ন্যাকস: ফল খাওয়ার জন্য সকালের নাস্তার সময় বা বিকেলের স্ন্যাকসের সময় বেছে নেওয়া ভালো।
  • ফলের রস পরিহার: ফলের রস না খেয়ে সরাসরি গোটা ফল খান। ফলের রসে ফাইবার থাকে না এবং এটি রক্তে শর্করা দ্রুত বাড়ায়।
  • রক্তে শর্করার মাত্রা পরীক্ষা: ফল খাওয়ার আগে ও পরে রক্তে শর্করার মাত্রা পরীক্ষা করে দেখুন, আপনার শরীরের ওপর ফলের কী প্রভাব পড়ছে।
  • ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ: একেকজনের শরীরের প্রতিক্রিয়া ভিন্ন হয়। তাই কোন ফল খেলে আপনার সুগার কতটা বাড়ছে, তা খেয়াল রাখা উচিত।
  • চিকিৎসক বা পুষ্টিবিদের পরামর্শ: সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, আপনার চিকিৎসক বা একজন পুষ্টিবিদের সাথে পরামর্শ করে একটি ব্যক্তিগত খাদ্যতালিকা তৈরি করা। তিনিই আপনার স্বাস্থ্যের অবস্থা অনুযায়ী সঠিক নির্দেশনা দিতে পারবেন।

গ্রীষ্মের মিষ্টি ফলগুলো সম্পূর্ণ বর্জন করার প্রয়োজন নেই, বরং সঠিক জ্ঞান এবং পরিমিতিবোধের মাধ্যমে ডায়াবেটিক রোগীরাও এগুলো উপভোগ করতে পারেন।

Post a Comment

Previous Post Next Post