একজন হজযাত্রীর রুটিন


 হজ ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ এবং এটি একটি দীর্ঘ ও সুনির্দিষ্ট ইবাদত। একজন হজযাত্রীর রুটিন হজের মূল পাঁচ দিনের কার্যক্রমে কেন্দ্রীভূত থাকে, যা জিলহজ মাসের ৮ তারিখ থেকে শুরু হয়ে ১২ অথবা ১৩ তারিখে শেষ হয়। এর বাইরেও মক্কায় অবস্থানের সময় সাধারণ ইবাদত ও অন্যান্য কার্যক্রম থাকে।

এখানে একজন হজযাত্রীর সাধারণ রুটিন বর্ণনা করা হলো, যা হজ মৌসুমের মূল দিনগুলোতে (৮-১২ জিলহজ) এবং এর আগে-পরে মক্কায় অবস্থানের সময়ে বিভক্ত:

হজ মৌসুমের বাইরে মক্কায় অবস্থানের সাধারণ রুটিন (হজের আনুষ্ঠানিকতা শুরুর আগে)

হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরুর আগে হজযাত্রীরা সাধারণত মক্কা শরিফ বা মদিনা শরিফে অবস্থান করেন। এই সময়ে তাদের রুটিন অনেকটাই ইবাদত-কেন্দ্রিক হয়:

  • ফজরের নামাজ: খুব ভোরে উঠে ফজরের নামাজ জামাতে আদায় করা।
  • জমজমের পানি পান: নামাজ শেষে জমজমের পানি পান করা, যা নিরাময় ও বরকতময় বলে বিশ্বাস করা হয়।
  • কোরআন তিলাওয়াত ও জিকির: ফজরের পর কিছুক্ষণ কোরআন তিলাওয়াত, তাসবীহ, তাহলিল ও অন্যান্য জিকিরে মশগুল থাকা।
  • নাশতা ও বিশ্রাম: সকালের নাশতা সেরে একটু বিশ্রাম নেওয়া।
  • কাবা শরীফে যাওয়া ও তাওয়াফ: দিনের যেকোনো সময় কাবা শরীফে গিয়ে নফল তাওয়াফ (কাবা প্রদক্ষিণ) করা। এটি অনেক সওয়াবের কাজ।
  • দুপুরের খাবার ও বিশ্রাম: দুপুরের খাবার গ্রহণ ও বিশ্রামের জন্য হোটেলে ফিরে যাওয়া।
  • জোহরের নামাজ: জোহরের সময় হলে মসজিদে হারাম (কাবা শরীফের মসজিদ) বা হোটেলের কাছে জামাতে নামাজ আদায় করা।
  • আসর ও মাগরিবের নামাজ: আসর ও মাগরিবের নামাজও জামাতে আদায় করা।
  • এশার নামাজ ও রাতের খাবার: এশার নামাজ আদায় করে রাতের খাবার খাওয়া।
  • তাহাজ্জুদ ও নফল ইবাদত: গভীর রাতে উঠে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করা এবং আল্লাহর কাছে দুআ ও ইস্তিগফার করা।
  • ধর্মীয় আলোচনা/পর্যবেক্ষণ: অনেক সময় বিভিন্ন ইসলামিক স্কলার বা মুআল্লিমের আয়োজিত ধর্মীয় আলোচনা বা দারসে অংশগ্রহণ করা।
  • ঐতিহাসিক স্থান পরিদর্শন (ঐচ্ছিক): ফাঁকা সময় পেলে মক্কা ও মদিনার ঐতিহাসিক স্থানগুলো (যেমন জাবালে নূর, জাবালে সাওর, মসজিদে কুবা, মসজিদে নববী) পরিদর্শন করা।

হজের মূল পাঁচ দিনের রুটিন (৮-১২ জিলহজ)

হজের প্রধান আনুষ্ঠানিকতা ৮ই জিলহজ থেকে শুরু হয় এবং এই দিনগুলো খুবই ব্যস্ততাপূর্ণ ও সুনির্দিষ্ট নিয়ম দ্বারা পরিচালিত হয়:

১. ৮ই জিলহজ (তারবিয়ার দিন):

  • ইহরাম বাঁধা: হজযাত্রীরা হজের নিয়তে ইহরাম বাঁধেন (মক্কা শরিফ বা বাসা/হোটেল থেকে)। পুরুষরা সেলাইবিহীন দুই টুকরা সাদা কাপড় পরেন।
  • মিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা: জোহরের নামাজের আগেই মিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। মক্কা থেকে মিনার দূরত্ব প্রায় ৮ কিলোমিটার।
  • মিনায় অবস্থান: মিনায় পৌঁছে জোহর, আসর, মাগরিব, ইশা এবং পরদিন ফজরের নামাজসহ মোট পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতে আদায় করেন। এই সময় তারা ইবাদত-বন্দেগিতে মগ্ন থাকেন।

২. ৯ই জিলহজ (আরাফার দিন):

  • আরাফাতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা: ফজরের নামাজ আদায় করার পর মিনা থেকে আরাফাতের ময়দানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। মিনা থেকে আরাফাতের দূরত্ব প্রায় ১৪.৪ কিলোমিটার।
  • আরাফাতে অবস্থান (হজের মূল রোকন): সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা হজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রোকন। এই দিনে হজযাত্রীরা আল্লাহর কাছে বেশি বেশি দুআ, জিকির, তওবা ও ইস্তিগফার করেন।
  • জোহর ও আসরের নামাজ: আরাফাতের ময়দানে এক আজানে জোহর ও আসরের নামাজ একসাথে আদায় করেন (জোহর ওয়াক্তে)।
  • সূর্যাস্তের পর মুজদালিফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা: সূর্যাস্তের পর মাগরিবের নামাজ না পড়েই আরাফাত থেকে মুজদালিফার দিকে রওয়ানা হন।
  • মুজদালিফায় রাতযাপন: মুজদালিফায় পৌঁছে এক আজানে মাগরিব ও ইশার নামাজ একসাথে আদায় করেন। এরপর তারা খোলা আকাশের নিচে রাত কাটান এবং জামারায় পাথর নিক্ষেপের জন্য পাথর সংগ্রহ করেন (সাধারণত ৪৯টি)।

৩. ১০ই জিলহজ (কোরবানির দিন/ইয়ামুন নাহার):

  • ফজরের নামাজ: মুজদালিফায় ফজরের নামাজ আদায় করে সূর্যোদয়ের আগে মিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।
  • জামারাতে পাথর নিক্ষেপ: মিনায় পৌঁছে বড় শয়তানের স্তম্ভে (জামারাতুল উকবা) সাতটি পাথর নিক্ষেপ করেন।
  • কোরবানি: এরপর কোরবানি (দম) আদায় করেন।
  • মাথা মুণ্ডন/চুল ছাঁটা: কোরবানি করার পর পুরুষরা মাথা মুণ্ডন করেন বা চুল ছোট করেন। নারীরা চুলের অগ্রভাগ ছাঁটেন। এর মাধ্যমে ইহরামের অধিকাংশ নিষেধাজ্ঞা উঠে যায় এবং তারা ইহরামের পোশাক পরিবর্তন করতে পারেন।
  • তাওয়াফে জিয়ারত: সম্ভব হলে এই দিনেই মক্কায় ফিরে কাবা শরীফে তাওয়াফে জিয়ারত (ফরজ তাওয়াফ) আদায় করেন। তবে ভিড় এড়াতে এটি ১২ই জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত বিলম্ব করা যেতে পারে।
  • মিনায় ফিরে আসা: তাওয়াফ ও সাই (যদি প্রয়োজন হয়) শেষে মিনায় ফিরে আসা।

৪. ১১ই জিলহজ:

  • জামারাতে পাথর নিক্ষেপ: মিনায় অবস্থিত তিনটি স্তম্ভে (ছোট, মধ্যম ও বড়) সাতটি করে মোট ২১টি পাথর নিক্ষেপ করেন। প্রতিটি স্তম্ভে পাথর মারার সময় 'আল্লাহু আকবার' বলতে হয়।
  • মিনায় অবস্থান: এই দিনেও মিনায় অবস্থান করে ইবাদত-বন্দেগি করেন।

৫. ১২ই জিলহজ:

  • জামারাতে পাথর নিক্ষেপ: ১১ই জিলহজের মতো এই দিনেও তিনটি স্তম্ভে সাতটি করে মোট ২১টি পাথর নিক্ষেপ করেন।
  • মিনায় অবস্থান/মক্কায় প্রত্যাবর্তন: পাথর নিক্ষেপের পর সূর্যাস্তের আগেই মিনায় অবস্থান করে বা মক্কায় ফিরে আসা যায়। যারা আরও এক দিন মিনায় থাকতে চান, তারা ১৩ই জিলহজ পর্যন্ত থাকতে পারেন।
  • তাওয়াফে বিদা (বিদায়ী তাওয়াফ): মক্কা থেকে বিদায় নেওয়ার আগে (যারা মক্কার বাইরে থেকে এসেছেন) তাওয়াফে বিদা (বিদায়ী তাওয়াফ) আদায় করা ওয়াজিব।

এই রুটিনটি একটি সাধারণ চিত্র। হজযাত্রীর বয়স, শারীরিক অবস্থা, হজের প্রকার (তামাত্তু, ইফরাদ, কিরান) এবং মুআল্লিমের ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভর করে কিছু রুটিনে সামান্য পরিবর্তন আসতে পারে। তবে মূল আনুষ্ঠানিকতাগুলো অপরিবর্তিত থাকে।

Post a Comment

Previous Post Next Post