সাম্প্রতিক ভারত–পাকিস্তান সংঘর্ষ আমাদের সামনে এমন এক বাস্তবতা তুলে ধরেছে, যা শুধুই সামরিক নয়। যুদ্ধ হয়তো ক্ষণিকের, কিন্তু কাহিনি চলে বহুদিন। আর সেই কাহিনিই হয়ে দাঁড়ায় সবচেয়ে বিপজ্জনক অস্ত্র। ক্ষেপণাস্ত্রের চেয়েও শক্তিশালী এই অস্ত্র হলো ভাষা—যার মাধ্যমে প্রতিটি রাষ্ট্র নিজের অবস্থানকে ন্যায্যতার চাদরে মুড়িয়ে তোলে।
ভারতের ‘অপারেশন সিঁদুর’ এবং পাকিস্তানের ‘অপারেশন বুনিয়ান আল-মারসুস’—দুই নামেই লুকানো রয়েছে একেকটি ব্যাখ্যা, একেকটি রাজনৈতিক ভাষ্য। ভারত যখন বলে সে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়ছে, তখন পাকিস্তান বলে সে আত্মসম্মান বাঁচানোর যুদ্ধ করছে। কিন্তু উভয় পক্ষই নিজেদের প্রথম আক্রমণকারী হিসেবে নয়, আত্মরক্ষাকারী হিসেবে তুলে ধরে।
গণমাধ্যম হয়ে ওঠে এই যুদ্ধের প্রধান মঞ্চ। ভারতের মিডিয়া ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’কে চিত্রায়িত করে সিনেমার মতো। প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য, "আমরা তাদের বুকে আঘাত করেছি"—শুধু শব্দ নয়, এক কৌশলী বয়ান। পাকিস্তান তার পক্ষ থেকে বেছে নেয় ধর্মীয় ভাষা—‘শহীদ’, ‘ইজ্জত’, ‘প্রাচীর’। এভাবেই গড়ে ওঠে একেকটি গল্প, যেগুলোর কেন্দ্রবিন্দুতে সত্য নয়, বরং নির্বাচিত ভাষ্য।
এই প্রক্রিয়ায় মানুষের কষ্ট, প্রাণহানি, শোক সবই হারিয়ে যায়। একটি কাশ্মীরি গ্রামে নিহত মাদ্রাসাশিক্ষকের পরিচয় পাল্টে যায় মিডিয়ার ভিন্ন ব্যাখ্যায়—ভারত তাকে দেখায় সন্ত্রাসী হিসেবে, পাকিস্তান শহীদ। অথচ সত্য ছিল: তিনি একজন নিরীহ শিক্ষক।
এই কাহিনির লড়াইয়ে সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয় সহানুভূতি ও সংলাপের। যখন উভয় দেশ শুধু নিজেদের কথাই শোনে, ‘ওরা’ ভুল আর ‘আমরা’ ঠিক—তখন কূটনীতি দুর্বলতা হয়ে ওঠে, আর যুদ্ধ হয়ে পড়ে গর্বের বিষয়। জনগণ তখন আর শুধু শান্তি চায় না, তারা চায় বিজয়। যে বিজয়ের ভিত্তি থাকে কৃত্রিম তথ্য ও অতিরঞ্জিত ব্যাখ্যায়।
উভয় পক্ষই আন্তর্জাতিক বৈধতা পেতে চায়। ভারত নিজেকে তুলে ধরে বৈশ্বিক নিরাপত্তার অংশীদার হিসেবে—যেমন যুক্তরাষ্ট্র করেছিল ইরাকে। পাকিস্তান তুলে ধরে নিজের সার্বভৌমত্ব ও ধর্মীয় বৈধতা। কিন্তু সত্য হারিয়ে যায় শব্দ ও ছবির চাপে।
এইভাবে ভাষা হয়ে ওঠে যুদ্ধের প্রকৃত অস্ত্র। পারমাণবিক বোমা যেমন মুহূর্তেই ধ্বংস করতে পারে, তেমনি একটি বয়ান ধ্বংস করে দেয় সত্যকে—নিরব, দীর্ঘমেয়াদি এবং ভয়ংকরভাবে কার্যকর।
Post a Comment