সূরা ফুরকান: ধীরে ধীরে কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার কারণ

 


সূরা ফুরকান কোরআনের ২৫তম সূরা। এর আয়াত সংখ্যা ৭৭। এই সূরাটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে এবং এর মূল বিষয়বস্তু হলো সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য স্পষ্ট করা, যা এই সূরার নাম 'ফুরকান' (পার্থক্যকারী) দ্বারাও বোঝা যায়। সূরাটিতে তাওহিদ, রিসালাত, আখেরাত এবং বিভিন্ন নবীর কাহিনী আলোচনা করা হয়েছে।

এই সূরার ৩২ নম্বর আয়াতে কাফিরদের একটি প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে, যেখানে তারা রাসূল (সা.)-এর প্রতি কোরআন একবারে অবতীর্ণ না হয়ে ধীরে ধীরে অবতীর্ণ হওয়ার বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছিল:

"যারা কুফরি করেছে, তারা বলে: 'তার কাছে পুরো কুরআন একবারেই অবতীর্ণ হলো না কেন?' আমি এভাবেই করেছি, যাতে তোমার হৃদয়কে দৃঢ় করতে পারি, আর আমি তা ধীরে ধীরে সুবিন্যস্ত করেছি।" (সূরা ফুরকান ২৫:৩২)

এই আয়াতের প্রেক্ষাপটে কোরআন ধীরে ধীরে অবতীর্ণ হওয়ার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে, যা আল্লাহ তায়ালা নিজেই বলেছেন এবং আলেমগণ ব্যাখ্যা করেছেন:

১. রাসূল (সা.)-এর হৃদয়ের দৃঢ়তা ও সাহস যোগানো:

কোরআন ধীরে ধীরে অবতীর্ণ হওয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর আত্মাকে দৃঢ় করা। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে, যখন তিনি হতাশ হতেন বা কাফিরদের পক্ষ থেকে অত্যাচার ও অপমানের শিকার হতেন, তখন নতুন নতুন আয়াত অবতীর্ণ হতো। এই আয়াতগুলো আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর প্রতি এক নতুন প্রেরণা ও সান্ত্বনা নিয়ে আসত, যা তাঁকে তাঁর দাওয়াতি কাজ চালিয়ে যেতে সাহায্য করত। ধীরে ধীরে আয়াত অবতীর্ণ হওয়ায় রাসূল (সা.) আল্লাহর সাহায্য অনুভব করতেন এবং তাঁর মনোবল অটুট থাকত।

২. আয়াতগুলো মুখস্থ করা ও আত্মস্থ করার সুবিধা:

কোরআন এমন একটি গ্রন্থ যা কেবল পড়ার জন্য নয়, বরং মুখস্থ করা এবং এর অর্থ গভীরভাবে অনুধাবন করার জন্যও। তৎকালীন আরবে অধিকাংশ মানুষ অশিক্ষিত ছিল। একসঙ্গে পুরো কোরআন অবতীর্ণ হলে তা মুখস্থ করা, বোঝা এবং তার বিধানগুলো আত্মস্থ করা তাদের জন্য অত্যন্ত কঠিন হতো। ধীরে ধীরে অবতীর্ণ হওয়ায় সাহাবিরা অল্প অল্প করে আয়াতগুলো মুখস্থ করতেন, তার ব্যাখ্যা বুঝতেন এবং সে অনুযায়ী নিজেদের জীবন পরিচালনা করতেন।

৩. ইসলামী বিধানগুলো ধাপে ধাপে প্রতিষ্ঠা করা:

ইসলামী শরিয়তের অনেক বিধানই ধীরে ধীরে কার্যকর হয়েছে। যেমন, মদ্যপান নিষিদ্ধ করার বিধান একবারে আসেনি, বরং তা কয়েকটি ধাপে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ব্যভিচারের শাস্তি, সুদ হারাম করা—এসব বিধানও ধাপে ধাপে অবতীর্ণ হয়েছে। যদি একসঙ্গে সব বিধান অবতীর্ণ হতো, তাহলে মানুষের পক্ষে তা মেনে চলা কঠিন হতো এবং সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দিত। ধীরে ধীরে অবতীর্ণ হওয়ায় মানুষ নতুন বিধানগুলোর সাথে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছিল।

৪. তৎকালীন সমস্যা ও জিজ্ঞাসার সমাধান প্রদান:

রাসূল (সা.)-এর জীবনে এবং সাহাবিদের সামনে যখনই কোনো নতুন সমস্যা আসত বা কাফিররা কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করত, তখন প্রায়শই কোরআনের আয়াত অবতীর্ণ হয়ে তার সমাধান দিত। এটি প্রমাণ করে যে কোরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ এবং এটি সময়ের চাহিদা অনুযায়ী নির্ভুল সমাধান প্রদান করে। যেমন, বদরের যুদ্ধ, ওহুদের যুদ্ধ বা মুনাফিকদের ষড়যন্ত্রের পরিপ্রেক্ষিতে আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে।

৫. দলিল ও প্রমাণ হিসেবে পেশ করা:

কোরআনের আয়াতগুলো ধীরে ধীরে অবতীর্ণ হওয়ার কারণে কাফিরদের বিভিন্ন প্রশ্নের তাৎক্ষণিক জবাব দেওয়া সম্ভব হতো। যখন তারা কোনো বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করত বা কোনো অবান্তর প্রশ্ন করত, তখন আল্লাহ উপযুক্ত আয়াত নাজিল করে তাদের সকল সন্দেহ দূর করে দিতেন। এটি কোরআনের অলৌকিকতা ও সত্যতার একটি অন্যতম প্রমাণ।

৬. অলৌকিকতা ও ভাষাগত সৌন্দর্য:

কোরআন ধীরে ধীরে অবতীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও এর প্রতিটি অংশের মধ্যে একটি অসাধারণ ভাষাগত সামঞ্জস্য, ধারাবাহিকতা এবং অলৌকিক সৌন্দর্য বিদ্যমান। এটি প্রমাণ করে যে এটি মানুষের রচিত কোনো গ্রন্থ নয়, বরং স্বয়ং আল্লাহর কালাম।

এভাবেই কোরআন ধীরে ধীরে, প্রায় ২৩ বছর ধরে রাসূল (সা.)-এর কাছে অবতীর্ণ হয়েছে, যা মুসলিম উম্মাহর জন্য এক বিশাল রহমত ও বরকত। এটি শুধু একটি আসমানী কিতাবই নয়, বরং একটি জীবনবিধান যা মানবজাতির জন্য পথপ্রদর্শক।

Post a Comment

Previous Post Next Post