নকশালরা কেন বারবার ব্যর্থ হয়: নেতৃত্বের বিভেদ থেকে রাষ্ট্রীয় দমন


 ভারতের ভূমিহীন কৃষক ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে ১৯৬০-এর দশকে নকশালবাড়িতে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা দ্রুতই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু অর্ধশতাব্দী পার হওয়ার পরেও এই আন্দোলন কখনোই সর্বভারতীয় পর্যায়ে সফল হতে পারেনি, বরং বারবারই ব্যর্থতার মুখ দেখেছে। এর পেছনে কিছু মৌলিক কারণ কাজ করেছে, যা বিশ্লেষণ করলে এর ব্যর্থতার চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

১. নেতৃত্ব ও আদর্শগত বিভেদ:

নকশাল আন্দোলনের শুরু থেকেই এর নেতৃত্ব ছিল অত্যন্ত ভঙ্গুর। চারু মজুমদারের নেতৃত্বে শুরু হওয়া এই আন্দোলন দ্রুতই একাধিক ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে ১৯৭১ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) বা সিপিআই (এম-এল) ভেঙে যাওয়ার পর পার্টি অসংখ্য ছোট ছোট উপদলে বিভক্ত হয়ে যায়। এই অন্তর্কোন্দল এবং আদর্শগত মতপার্থক্য আন্দোলনের মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়। নেতৃত্বের এই বিভেদ সরকারকে নকশাল দমনে উল্লেখযোগ্য সহায়তা করে এবং ১৯৭২ সালের মধ্যে আন্দোলন অনেকটাই স্তিমিত হয়ে পড়ে।

আদর্শগতভাবে, নকশালরা চীনের নেতা মাও সে তুং-এর মতাদর্শ দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিল। তাদের স্লোগান ছিল "চীনের চেয়ারম্যান, আমাদের চেয়ারম্যান"। এই স্লোগানটি ভারতের মতো একটি বহুভাষিক ও বহুসংস্কৃতির দেশে, যেখানে জাতীয়তাবাদী চেতনা অত্যন্ত প্রবল, সেখানে তেমন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। বিশেষত ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের পর মাওয়ের প্রতি সাধারণ ভারতীয়দের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভ ছিল। মাওবাদের 'বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস' এবং 'শ্রেণিশত্রু খতমের রাজনীতি'—এই ধরনের উগ্রপন্থা সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতি তৈরি করে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি তাদের অনাগ্রহ দেশবাসীর কাছে নকশালদের ভাবমূর্তি নষ্ট করে দেয়।

২. অসংগঠিত কাঠামো ও কৌশলগত ত্রুটি:

নকশাল আন্দোলন একটি সুসংগঠিত গণসংগঠন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছিল। তারা মূলত গ্রামীণ এলাকার ক্ষুদ্র কৃষক ও আদিবাসীদের ওপর নির্ভর করলেও, ব্যাপক জনগোষ্ঠীর মধ্যে তাদের আদর্শ ছড়িয়ে দিতে পারেনি। সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতি অবজ্ঞা এবং তাৎক্ষণিক সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা তাদের দীর্ঘমেয়াদী সাফল্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাদের গেরিলা যুদ্ধ পদ্ধতি এবং বিচ্ছিন্ন গুপ্তহত্যার কৌশল জনযুদ্ধ হিসেবে বিবেচিত হয়নি, কারণ তারা জনতাকে নিজেদের সাথে পুরোপুরি সম্পৃক্ত করতে পারেনি। রাজনৈতিক পড়াশোনা বা তাত্ত্বিক ভিত্তি দুর্বল থাকায় অনেক তরুণ ও ছাত্র এই আন্দোলনে যোগ দিলেও, আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ও কৌশল সম্পর্কে তাদের স্পষ্ট ধারণা ছিল না।

৩. রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন:

ভারত সরকার নকশাল আন্দোলন দমনে শুরু থেকেই অত্যন্ত কঠোর অবস্থান নিয়েছিল। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় নকশালদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক দমন-পীড়নের নির্দেশ দেন। পুলিশকে নির্বিচারে হত্যা, অকারণে যে কাউকে গ্রেপ্তার এবং লক-আপে নির্যাতন বা ভুয়া সংঘর্ষে হত্যার মতো ক্ষমতা দেওয়া হয়। এক মাসের মধ্যেই সরকার এই আন্দোলনকে অনেকটাই দমন করতে সক্ষম হয়। বহু শীর্ষ নেতা হয় নিহত হন অথবা গ্রেপ্তার হন। সরকারের এই কঠোর পদক্ষেপ নকশালদের মনোবল ভেঙে দেয় এবং জনসমর্থন আরও কমে যায়।

৪. আঞ্চলিক সীমাবদ্ধতা ও সর্বভারতীয় গ্রহণযোগ্যতার অভাব:

নকশাল আন্দোলন প্রাথমিকভাবে পশ্চিমবঙ্গ (বিশেষত নকশালবাড়ি) এবং অন্ধ্রপ্রদেশের কিছু অঞ্চলে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও এটি শুরু হলেও, কখনোই এটি সর্বভারতীয় গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। ভারতের বিশাল ভৌগোলিক আয়তন এবং বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি ও ভাষার কারণে একটি একক আদর্শে সারা দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা অত্যন্ত কঠিন ছিল। এছাড়াও, সে সময় যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতাও আন্দোলনকে সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে বাধা দেয়।

৫. সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট ও জনবিচ্ছিন্নতা:

যদিও নকশাল আন্দোলনের মূল কারণ ছিল গ্রামীণ সমাজের গভীর শোষণ ও দারিদ্র্য, কিন্তু আন্দোলনের উগ্রপন্থা এবং সাধারণ মানুষের সাথে সংযোগ স্থাপনে ব্যর্থতা তাদের জনবিচ্ছিন্ন করে তোলে। ধীরে ধীরে কিছু অঞ্চলে কৃষিসংস্কার এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তনের ফলে গণ অসন্তোষের তীব্রতা কিছুটা কমে আসে, যা আন্দোলনের শক্তিকে দুর্বল করে দেয়।

সংক্ষেপে, নকশাল আন্দোলন ভারতের বঞ্চিত মানুষের অধিকারের জন্য একটি প্রতিবাদ হলেও, এর অভ্যন্তরীণ বিভেদ, আদর্শগত অস্পষ্টতা, কৌশলগত ত্রুটি এবং সরকারের কঠোর দমন-পীড়নই এর বারবার ব্যর্থ হওয়ার মূল কারণ।


Post a Comment

Previous Post Next Post