বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা: কোন সূচকে কি অবস্থা?


 বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে একটি চ্যালেঞ্জিং সময় পার করছে, যেখানে কিছু সূচক ইতিবাচক থাকলেও, সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নিয়ে উদ্বেগ কাটছে না। বিশেষ করে বিশ্ব অর্থনীতির অস্থিরতা, ডলারের উচ্চ বিনিময় হার এবং মূল্যস্ফীতি দেশের অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করছে।

১. মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি:

বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান সূচক হলো জিডিপি প্রবৃদ্ধি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সাময়িক হিসাবে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৩.৯৭ শতাংশ। এটি গত দুই দশকের মধ্যে (কোভিড-১৯ মহামারির সময় বাদ দিলে) সর্বনিম্ন প্রবৃদ্ধি।

  • ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চূড়ান্ত হিসাব: ৪.২২ শতাংশ
  • ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি: ৫.৭৮ শতাংশ উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাংক চলতি অর্থবছরে ৩.৩ শতাংশ এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ৩.৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে। কৃষি ও সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমেছে, যেখানে শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩.৫১ শতাংশ।

২. মাথাপিছু আয়:

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৮২০ মার্কিন ডলার। এটি এ যাবৎকালের রেকর্ড।

  • ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মাথাপিছু আয়: ২ হাজার ৭৩৮ ডলার
  • ২০২২-২৩ অর্থবছরে মাথাপিছু আয়: ২ হাজার ৭৪৯ ডলার তবে ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ায় টাকার অঙ্কে মাথাপিছু আয়ের হিসাবে পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। টাকার অঙ্কে চলতি অর্থবছরে মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৩৯ হাজার ২২১ টাকা।

৩. মূল্যস্ফীতি:

মুদ্রাস্ফীতি বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ৯.৩২ শতাংশ, যা গত ২২ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।

  • ২০২৩ সালের এপ্রিল মাস: ৯.২৪ শতাংশ
  • ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাস: ১০.৮৯ শতাংশ (বিবিএসের হিসাবে) যদিও সরকার মূল্যস্ফীতির নিম্নমুখিতার তথ্য দিচ্ছে, নিত্যপণ্যের বাজারে এর সুফল এখনও পুরোপুরি মেলেনি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস সুদের হার বাড়ানোর মতো পদক্ষেপ নিয়েছেন।

৪. বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ:

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৫ সালের ২৮ মে তারিখে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৫.৮০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যালেন্স অব পেমেন্টস পদ্ধতি (বিপিএম৬) অনুযায়ী, রিজার্ভের পরিমাণ ২০.৫৬ বিলিয়ন ডলার।

  • ২০২৩ সালের ১৪ জুলাই: ২৪.২৫ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখতে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে, তবে আমদানির চাপ ও ডলারের উচ্চ মূল্য এখনও চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে।

৫. রেমিট্যান্স প্রবাহ:

রেমিট্যান্স প্রবাহে ইতিবাচক ধারা বজায় আছে। চলতি অর্থবছরের ৩১ মে পর্যন্ত দেশে ২ হাজার ৭৫০ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে।

  • গত অর্থবছরের একই সময়: ২ হাজার ১৩৭ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলার বছর ব্যবধানে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে ২৮.৭০ শতাংশ। এটি দেশের অর্থনীতিতে ডলারের জোগান বাড়াতে সহায়তা করছে।

৬. রপ্তানি আয়:

রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হলেও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ।

  • ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাস: ৫৭২ কোটি ৪৩ লাখ ডলার (আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১১.৪৫ শতাংশ বেশি)
  • ২০২২-২৩ অর্থবছরের মোট রপ্তানি আয়: ৫ হাজার ৫৫৬ কোটি ডলার (প্রবৃদ্ধি ৬.৬৭ শতাংশ) চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ হাজার ২০০ কোটি ডলার।

৭. আমদানি ব্যয়:

আমদানি ব্যয়ে কিছু নিয়ন্ত্রণ আনা সম্ভব হয়েছে।

  • ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমদানি ব্যয়: ৭৫.০৬ বিলিয়ন ডলার (আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ১৬% কম)
  • ২০২৩ সালের জুলাই-আগস্ট: পণ্য আমদানি কমেছে ৬.২৫ শতাংশ, তবে ব্যয় বেড়েছে ২.৪৫ শতাংশ। ডলার সংকটের কারণে সরকার আমদানি নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে, যার ফলে ব্যয় কিছুটা কমেছে।

৮. সরকারি ঋণ ও বাজেট ঘাটতি:

বাংলাদেশের মোট সরকারি ঋণ-জিডিপি অনুপাত ৪০ শতাংশ, যা আইএমএফ নির্ধারিত ৫৫ শতাংশ সীমার নিচে। তবে সরকারের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা রাজস্ব সংগ্রহের ওপর নির্ভরশীল।

  • ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মোট বাজেট: ৭,৬১,৭৮৫ কোটি টাকা
  • সামগ্রিক ঘাটতি: ২,৬১,৭৮৫ কোটি টাকা (জিডিপির প্রায় ৫.২ শতাংশ) ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করা হচ্ছে, যেখানে বাজেট ঘাটতি ধরা হতে পারে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা।

৯. বৈদেশিক ঋণ:

বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ আবারও ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।

  • ২০২৫ সালের জুন শেষে: প্রায় ১০৪ বিলিয়ন ডলার
  • ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে: ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছিল বেসরকারি খাতের বৈদেশিক ঋণ চার বছরে সর্বনিম্ন স্তরে নেমে এসেছে (২০২৫ সালের জানুয়ারি শেষে ৯.৮০ বিলিয়ন ডলার)।

সামষ্টিক চ্যালেঞ্জ:

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, জ্বালানিসংকট, বিনিয়োগে মন্থরতা, ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব এবং ডলারের অস্থির বিনিময় হার বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারের রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় আরও সুদূরপ্রর্শী নীতি গ্রহণ জরুরি।


Post a Comment

Previous Post Next Post